মহাভারতের ইরাবান কাহিনীকে সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তুলে ধরে চন্ডীতলা প্রম্পটারের নতুন নাটক ইরাবান গাথা

চন্ডীতলা প্রম্পটার এর প্রযোজনায় সম্প্রতি একাডেমি তে মঞ্চস্থ হয়ে গেল নাটক ইরাবান গাথা। নির্দেশনায় রাকেশ ঘোষ। মহাভারত মহাকাব্য আশ্রিত এই নাটক। মূল মহাভারতের আখ্যানের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে সংযুক্ত হয়েছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন লোকগাথা, লোকবিশ্বাস, লোক-আখ্যান। সে কারণেই আজও তা জীবিত ও প্রাসঙ্গিক।


নবম শতকের মহাভারতের তামিল অনুবাদে ‘কালাপ্পালি’ নামে এক প্রথার উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথানুযায়ী, কোনো বীর যদি দেবী কালিকার সামনে নিজেকে বলি দেয়, তাহলে যুদ্ধে সেই পক্ষের জয় অবধারিত। এই প্রথা মেনেই পান্ডবপক্ষের বিজয়লাভের জন্য কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে দেবী কালিকার চরণে আত্মবলি দিয়েছিলো কনিষ্ঠ কৌন্তেয় অর্জুন ও নাগকন্যা উলূপীর ক্ষেত্রজ সন্তান ইরাবান বা আরাবান। আত্মবলির আগে অকৃতদার যুবক ইরাবান শর্ত দিয়েছিলো যে সে অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে না। যৌবনের সব রঙটুকু রসটুকু উপভোগ করে তবেই সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে। কিন্তু ইরাবানকে বিবাহে ইচ্ছুক কোনো পাত্রী পাওয়া যায়নি। নিশ্চিত অকাল-বৈধব্যকে স্বীকার করতে কোনো কন্যাই রাজি হয়নি। তখন শ্রীকৃষ্ণ নারী রূপ ধারণ করে। নাম হয় মোহিনী। মোহিনী ও ইরাবানের বিবাহ হয়। ফুলশয্যার বিছানায় মোহিনীর শরীরের আদরে ডুবে যেতে যেতে ইরাবান মোহিনীর রক্তিম বস্ত্রের অন্তরালে দেখতে পায় পীতাম্বর, দেহের চন্দন সুবাসের মধ্যে থেকে পায় মাখন-ননীর আঘ্রান, কটিদেশের চন্দ্রহারের ফাঁকে দেখে মোহনবাঁশি। তবুও ইরাবান মোহিনীকেই উজাড় করে দেয় সব প্রেম। ফুলশয্যার পরদিন ইরাবানের বলি হয়। কথিত আছে, ইরাবানের মৃত্যুর পর রীতি অনুযায়ী মোহিনী-শ্রীকৃষ্ণ শ্বেত বস্ত্র পরে বৈধব্য ধারণ করে, কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে স্বামী ইরাবানের শোকে হাহাকার করে আর্তনাদ করে। তামিলনাড়ুর কুভাগামে ইরাবানের মন্দির আছে। তামিল মাস চিত্তিরাইতে, বাংলা মাস চৈত্রে, আঠারো দিন ধরে উৎসব চলে সেখানে। আজও প্রতিবছর এই উৎসবে একই অঙ্গে চন্দন-ননী-মাখনের গন্ধ মাখা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা মোহিনী-সাজে ইরাবানকে স্বামীরূপে গ্রহণ করেন, রাত্রিযাপন করেন, পরের দিন ভোরেই বৈধব্য নিয়ে শোকপালন করেন।

তামিল মহাভারতের এই আখ্যানকে সমকালের দৃষ্টিতে ধরেছেন নির্দেশক রাকেশ ঘোষ। তার কথায়, বর্তমান যুবসমাজ মোহিনী-মায়ায় আচ্ছন্ন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সক্রিয় আই টি সেল তাদের মগজ ধোলাই করে অন্তরে গেঁথে দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ। এই মোহগ্রস্ত তরুণরা একে অপরকে মেরে আস্ফালন করছে ধর্ম-গৌরবের। এরা প্রতিনিয়ত একে অপরকে মারছে এবং মরছে। ভ্রান্ত দেশোদ্ধার, দেশসেবার মোহে এদের আচ্ছন্ন করে নির্মাণ করা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থসিদ্ধির ক্ষমতা কায়েমের সিঁড়ি হিসেবে। নিজেদের অজান্তেই এরা বলি হচ্ছে প্রতিনিয়ত’। নাটকে দেখতে পাই শ্রীকৃষ্ণ নির্মিত এই মায়াজাল ছিন্ন করে মোহগ্রস্ত ইরাবানদের মুক্ত করার প্রচেষ্টা করে জননী উলূপী। সে কি সফল হয়? নাকি অসীম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রশক্তি শ্রীকৃষ্ণর বৈধব্য-ছলনা চক্রে সেও পরাজিতা হয়? তারই উত্তর উঠে আসে এই নাটকে।

বিশেষ করে সঙ্গীত (অভিজিৎ আচার্য্য) এবং অভিনয় এই নাটককে বেধে রাখে। তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছে মঞ্চ স্থাপত্য (অনিলাভ চ্যাটার্জী) এবং দৃশ্যায়ন। কৃষ্ণ ও মোহিনীর চরিত্রে রঞ্জন বোস এবং উলূপীর চরিত্রে কল্পনা বরুয়ার অভিনয় মন ছুঁয়ে যায়। ইরাবানের ভুমিকায় কৌস্তুভ মজুমদার এবং দূতের ভুমিকায় প্রদীপ রায় যথাযথ। এছাড়াও অভিনয়ে ছিলেন অর্জুন: কৃষ্ণেন্দু ভট্টাচার্য্য, ভীম: কৌশিক মাল। কোরাস: সৌভিক ঘোষ, সন্দীপ ঘোষ, তমসা ঘোষ, অন্বেষা মুখার্জি, শ্রেয়শ্রী আচার্য্য, সৌরিমা তপাদার, আরাত্রিকা চৌধুরী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *