শিল্প-সংস্কৃতির আঙ্গিনায় মূকাভিনয় শিল্পটি আজ হারিয়ে যেতে যেতেও নতুন প্রজন্ম তাদের নতুন ভাবনা চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়ে নতুন আশার সঞ্চার ঘটাচ্ছে। মাইমওয়ালা এমনি একটি সমসাময়িক মাইম গ্রুপ। গত ১০ ই মে মাইমওয়ালার তরুণ তুর্কিরা তাদের এমনই অনবদ্য অভিনয় প্রদর্শন করল হাওড়া উত্তর পাড়ার গণভবনে। ‘আমরা নাট্যদলের’ উদ্যোগে তিন দিনের নাট্য উৎসবের সেদিন ছিল প্রথম দিন। মাইমওয়ালার দশজন শিল্পী, তাদের চারটি নতুন প্রযোজনা পরিবেশন করে। মাইমওয়ালার কর্ণধার দেবাঞ্জন বেরা জানান, দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে তারা মূকাভিনয়ের অনুষ্ঠান পরিবেশন করে আসছে। মাইম আর্টের মাধ্যমে নতুন ধারণা এবং চিন্তাভাবনা নিয়ে কাজ করছে। সম্প্রতি কবিতা ও মাইম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা মূলক কাজ করে চলেছে । কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চে, পশ্চিমবঙ্গ নাট্যমেলায় , বিভিন্ন জেলার নাট্যমেলা ও বিবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মূকাভিনয় পরিবেশন করে চলেছে মাইমওয়ালা।
গণভবনে মাইমওয়ালা যে নির্বাক অভিনয় উপস্থাপন করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বইচোর , লোভী কাঠুরিয়া এবং ধর্ম । মানুষের জীবনে বইএর গুরুত্ব সম্পর্কে সকলেই জানেন । বই হল জ্ঞানের আকর , আনন্দের খনি , অবসরের সঙ্গী । বই মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধু । এক সময় দেখা যেত মানুষের বই পড়ার অভ্যাস, বইএর প্রতি ব্যাকুল আগ্রহ। কিন্তু আধুনিক জীবনে মানুষ বইএর কাছ থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে । কিন্তু কেন ? চিন্তা করলেই দেখা যাবে মানুষের কাছ থেকে বইকে কৌশলে কেউ সরিয়ে নিচ্ছে । সে কে ? এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় ‘বইচোর’ মূকাভিনয়ে। মাইমওয়ালার আর একটি উপস্থাপনা ‘লোভী কাঠুরিয়া ‘। এই গল্পটা প্রায় সবার জানা। নীতিশিক্ষামূলক এই গল্প যেমন মজার তেমন শিক্ষণীয়। একজন কাঠুরিয়ার সততায় মুগ্ধ হয়ে জলদেবতা তাকে সোনার ও রূপার কুঠার দান করে । অন্য এক কাঠুরিয়া তা জানতে পেরে সোনার কুঠারের লোভে জঙ্গলে গিয়ে জলদেবতার সঙ্গে ছলনা করে। তার মিথ্যাচারে ক্রুদ্ধ হয়ে দেবতা তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেয় । মাইমওয়ালার সদস্যদের নির্বাক অভিনয়ে বিষয়টি পরিস্ফুট হয়েছে । আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপনা হল ‘ধর্ম’ । ধর্মকে কেন্দ্র করে বিভেদ ও সংঘাতের ঘটনা বারবার ঘটেছে। কিন্তু আমরা জানি, সবার উপরে মানুষ সত্য । তাই ধর্মীয় দাঙ্গা অশান্তি তৈরি করলেও মানুষ যখন বুঝতে পারে মনুষ্যত্বই তার আসল পরিচয়, তখন পারস্পরিক মিলনের মাধ্যমে শান্তি ফিরে আসে।
কথা না বলে, শুধুমাত্র শরীর সঞ্চালনা ও অভিব্যক্তির মাধ্যমে এই বিষয়গুলি প্রকাশ করা যেমন বিস্ময়কর তেমনই উপভোগ্য । অংশগ্রহণে ছিল অনীশ , অর্ণব, সায়ন , দীপা, সঞ্চিতা, সহেলী , ভূমিকা ও বর্ষা। মিউজিক ও লাইটের যথার্থ ব্যবহার প্রতিটি বিষয়কে আরো নান্দনিক করে তুলেছিল।
মূকাভিনয়কে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আরো বেশি পরিচিত ও প্রাসঙ্গিক করার জন্য মাইমওয়ালা নানা রকমের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। দলের শিল্পীদের কুশলতা দেখে নিয়মিত চর্চার পরিচয় পাওয়া যায়, তা ছাড়া কর্মশালার মাধ্যমে নতুন প্রতিভা অন্বেষণ ও গড়ে তোলা এদের অন্যতম পদক্ষেপ । প্রতি বছর মাইমওয়ালা কর্মশালার আয়োজন করে, সেখানে মূকাভিনয় সম্পর্কে আলোচনা ও ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে নতুন শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা হয় । নিজেদের দলের বাইরেও অন্য নাট্যদলে ও বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কর্মশালা পরিচালনা করেছেন মাইমওয়ালার পরিচালক দেবাশীষ গাঙ্গুলী । এর দ্বারা নতুন প্রজন্মের মধ্যে প্রসারিত হচ্ছে মূকাভিনয় । মূকাভিনয়ের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হয় ছাত্রছাত্রীরা। মূকাভিনয় অতি প্রাচীন শিল্প, আমাদের দেশে প্রাচীন অভিনয় ও নৃত্যকলার শাস্ত্রে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু কালের নিয়মে যে শিল্পমাধ্যমটি হারিয়ে যেতে বসেছে তাকে বাঁচিয়ে তোলাই মাইমওয়ালার লক্ষ্য । কিন্তু মাইমওয়ালার শিল্পীদের আক্ষেপ সরকার মূকাভিনয়ের জন্য কোন পৃথক উৎসব করেন। তাছাড়াও বিভিন্ন নাট্যমেলাতেও মূকাভিনয় কমই দেখা যায়। তাঁদের আরও বক্তব্য সরকারি প্রচেষ্টার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে সংস্কৃতিমনস্ক মানুষদের। অভিভাবকেরা আজকাল ছেলেমেয়েদের যেভাবে নাচ, গান, আবৃত্তি শেখান , সেইভাবে মূকাভিনয় শেখাতে আগ্রহী হলে এই শিল্প সম্পর্কে আগামী প্রজন্মও সচেতন নন। প্রসঙ্গত মাইমওয়ালার কলাকুশলীরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানান যে শিশু ও কিশোরকিশোরীরাই সবচেয়ে বেশি আনন্দ লাভ করে তাদের মূকাভিনয়ে।
মাইমওয়ালার পরিচালক দেবাশীষ গাঙ্গুলী বলেন, “মাইমওয়ালার পরিচালক মূকাভিনয়ের মাধ্যমে শরীরচর্চা ও মানসিক বোধেরও চর্চা ঘটে সহজেই। তাই মূকাভিনয়ের আরো বেশি প্রচার দরকার, সচেতনতা দরকার । বিভিন্ন বিদ্যালয়ে সহপাঠক্রমিক কাজে মূকাভিনয়কে গ্রহণ করার সুযোগ আছে”।
উত্তর পাড়া আমরা নাট্য সংস্থার পক্ষে অরিন্দম মুখার্জী জানান, এবার তাদের ৬৩তম নাট্যোৎসব। উত্তরপাড়ার সংস্কৃতি প্রেমি মানুষের সহোযোগিতায় তারা তাদের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে চলেছে।
উত্তরপাড়ার গণভবনে এদিন প্রেক্ষাগৃহের আসন ছিল মোটামুটি পূর্ণ। টিভির একঘেয়ে কুটকাচালির সিরিয়াল থেকে মুখ ফিরিয়ে উত্তরপাড়ার দর্শকরা মূকাভিনয়ের ভিন্নতর স্বাদের সন্ধানে হাজির হয়েছিলেন।