ক্রিয়েটিভ ডান্স ওয়ার্কশপের আয়োজনে ২৬ মার্চ সন্ধেয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ঠাকুরদালানে মঞ্চস্থ হয়ে গেল দুটি ভিন্ন স্বাদের প্রযোজনা। যার শিরোনাম ছিল ‘কর কলঙ্কশূন্য’। প্রথম নিবেদনে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী কবি ল্যাংস্টন হিউজ (Langston Hughes) এর বিখ্যাত কবিতা ‘সুদূর দক্ষিণে ডিক্সিতে’ অবলম্বনে একটি নৃত্য নির্মিতি। পরিবেশনায় ছিল ক্রিয়েটিভ ডান্স ওয়ার্কশপ-কলকাতা। পরিচালনায় ছিলেন ড. শেলী পাল। পরবর্তী নিবেদনে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাৎসী বাহিনীর নৃশংসতার প্রেক্ষাপটে নারায়ণ সান্যাল রচিত ‘মৃত্যোর্মা অমৃতম’ অবলম্বনে ধনঞ্জয় ঘোষালের একটি দৃশ্যশ্রাব্য প্রযোজনা ‘তুলে নাও তোমার পতাকা’। পরিচালনায় ছিলেন চন্দন মজুমদার।
এই দুটি প্রযোজনারই একটি ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক পটভূমি থাকলেও ভীষণ ভাবে সমসাময়িক। তাই এই উপস্থাপনা মন ছুঁয়ে যায়। কারণ এই সব নৃত্য নির্মিতির মধ্যে যেমন রয়েছে শৈল্পিক উৎকর্ষতা, অপরদিকে উঠে এসেছে শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের আর্তনাদ এবং শাসকের অত্যাচার।
ক্রিয়েটিভ ডান্স ওয়ার্কশপ এর নৃত্য পরিচালক শেলী পাল জানালেন, ‘বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এই ধরনের বিষয় তুলে ধরার তাগিদ অনুভব করছি। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী পটভূমিতে লেখা ‘সুদূর দক্ষিণে ডিক্সিতে’ কবিতার ছত্রে ছত্রে রয়েছে মানুষের সব হারানোর বেদনা, শাসকের অত্যাচার। সর্বোপরি শোষিত মানুষের উঠে দাঁড়ানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষাও ফুটে উঠেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রেক্ষিত অবলম্বনে নির্মিত ‘তুলে নাও তোমার পতাকাতে’ দেখা যাচ্ছে যখন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যাওয়ার নোটিশ এসে গেছে, ছোট থেকে বড় যেতে হবে সকল ইহুদী মানুষদেরকেই তখন সেই মৃত্যু ভয় থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে সেই অনাথ আশ্রমের ইহুদি পরিচালকের হাত ধরে মঞ্চস্থ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’। যেখানে প্রতিটি শিশুই অমল হয়ে উঠছে। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও সাহস সঞ্চয় করছে। বিষয়বস্তু গল্প সময় সবটা ভিন্ন হলেও প্রাসঙ্গিকতা কোথাও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করছি যেখানে মানুষের অস্তিত্বই সঙ্কটের মুখে। যেখানে বিরুদ্ধ স্বরকে অবদমন করার ভয়ানক একটা প্রচেষ্টা চলছে। তাই এই সময় দাঁড়িয়ে সেই সময়ের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য অনায়াসে খুঁজে নেওয়া যায়। একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে মনে করছি এটাই বোধহয় শ্রেষ্ঠ সময় যেখানে এই দম বন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় হিসেবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে এই বিরুদ্ধ কন্ঠ। মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার প্রতিবাদের কন্ঠ, আত্মবিশ্বাসের কন্ঠ। আর সে কারণেই এই দুটো প্রযোজনাকে একসাথে মঞ্চস্থ করার চেষ্টা করেছি। কারণ সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে একমাত্র মঞ্চটাই আমাদের প্রতিবাদের জায়গা, একমাত্র লড়াইয়ের জায়গা। সেখান থেকেই হার না মানার বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে’।